রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১২

সম্প্রদান কারক


-------মোঃ নাঈম হোসেন (নয়ন)

মাঝে মাঝে অবাক হই যখন ভাবি ভালবাসা বাসির লিস্টে সর্বপ্রথম কার জায়গা যাকে ভালোবাসি সে নাকি আমার বাবা মা।

সম্প্রদান কারকের বেশ জনপ্রিয় একটা উদাহরন হচ্ছে- সৎ পাত্রে কন্যাদান। হয়ত সব বাবা মাই এরকমই ভাবে, কেনই ভাববে না। সব ছেলে মেয়ে যেইভাবে ভালবাসি ভালবাসি বলে বাস্তবতা থেকে একেবারে ভিন্ন কল্পনার রাজ্যে পাংখা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাতে বাবা মা সেই রাজ্যে বাধ্য হয়েই ১৪৪ ধারা জারি করেছে। দেখা যাক আজ এই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা বা কিছুটা শিথিল করা যায় কিনা!!!

-কিরে মোনা তুই গত দুদিন ক্লাসে আসিস নাই কেন?
-আররে আর বলিস না বড় মামা কোথেকে জানি একটা ভেড়া ধড়ে এনেছে।
-ভেড়া!! মানে কী?
-একটা ছেলে বিদেশে থাকে ছুটিতে এসেছে বিয়ে করতে, আর ওম্নি মামা ধরে এনেছে আমার জন্য।
-ছেলেটাতো বিদেশে থাকে তা ঝুলে পড়তে সমস্যা কোথায়?? আর ভেড়া বললি কেন?
-বলে কিনা, সে বিয়ে করে আমাকে এখানে রেখে যাবে, আর প্রতি বছর এসে দেখে যাবে!! মানে প্রতি বছর এসে আমাকে একটা করে ক্যাপসুল খাওয়াবে, শালা ভন্ড, মনে করেছে আমি কিছু বুঝি না।
-ও এই কথা হি হি হি।
-রাফসান আসেনি।
-হ্যা ওইতো লাইব্রেরিতে বসে আছে।


মোনার ভাল বন্ধু রাফসান। আপনারা অন্য কিছু ভাববেন না যেন!! They are just good friends. এই ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল, কিন্তু কোন মেয়ের বাবা মার মতে এই সৎ পাত্রে কিছুটা ফুটো আছে, মেয়েকে এই পাত্রে ঢাললে ফুটো দিয়ে পড়ে হারিয়ে যাবে। মানে একটু গরীব আর কি।

-কিরে কি করিস।
-ভুগোল নোট নিচ্ছি। কি খবর তোর?
-বইয়ের থেকে মুখ তুলে একটু তাকা বাপ। আমার রাগে মাথা কিলবিল করছে।
-তোর মাথায় ঊকুন আছে, রাগটাগ কিছুই নাহ। হা হা হা।
-দেখ কুত্তা রাগাবিনা বলে দিলাম। খুন করে ফেলবো।
-ওরে আল্লাহ আমি ভয় পাইছি।

মোনা সেই ভেড়া নাহ বিদেশি ভেড়ার গল্প করছে। আমি যেহেতু গল্পের লেখক তাই আমি রাফসানের মনের কথা জানি। সে মোনাকে খুবি পছন্দ করে তবে এই মেয়ের যেই রাগ, তাতে কখনই বেশি দূর আগানো যাবে না মনে হয়। রাফসান কিন্তু লাইব্রেরিতে বসে বসে ভুগোলের সাথে মোনাকে মিশিয়ে কবিতা লিখছিলো। হা হা হা। লেখক হওয়ার কত মজা দেখলেন!!
‘It’s a believe when
you stepped into the small island
and breathing like a frantic volcano.
I cordially feel the rhythm of your warm skin,
No matter how long I burned that day,
I am ready for each and every day’.(-nyeeM)

-আব্বা আমি এখন বিয়ে করবোনা।
-তো কখন বিয়ে করবি।
-আগে লেখা পড়া শেষ করি তারপর..
-এরকম ভালো ছেলে পাওয়া যাবে নাহ।
-এ ভালো না ছাই...ভেড়া কোথাকার।
-ফিস ফিস করছিস কেন? সাপ হয়েছিস নাকি।
-না মানে বলছিলাম ছেলের মাথায়তো টাক, আর বয়স অনেক বেশি।
-তোর মায়ের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ১২ বছর। আমরা কি সংসার করিনি, নাকি?

এইটাইপের বাবাদের ঘাড়ের রগ তেরা, এদের বুঝিয়ে কোন লাভ হবে নাহ। এরা যা বলবে তাই করবে। সৎ পাত্র মানেই টাকা পয়সায় চকচক করবে। ছেলের চান্দি ফাকা হলেই কি, আর ____ ছোট হলেই কি। মানে আমি হাইটের কথাই বলছিলাম!!!!

আজ শুক্রবার। মোনা ভেবেছিল বেলা করেই ঘুমাবে। কিন্তু নাহ হলো না। ঐ যে তার বাবার সুপাত্র ড্রয়িং রুমে এসে ভে ভে করছে। মোনাকে নিয়ে নাকি সিনেমা দেখতে যাবে। হায়রে ছেলে মেয়ের কোন মুল্যই বাবা মার কাছে নেই।

-আপনিতো কিছুই খাচ্ছেন নাহ।
-(শালা বুইড়া আপনি মারাচ্ছে...!!) নাহ এইতো খাচ্ছি।
-জানেন আপনাকে প্রথমদিন দেখেই আমার খুব ভালো লেগে গেছে।
-(ভালোতো লাগবেই কচি মাইয়া পাইছো, তোমার চান্দিতে সকাল বিকাল চুমা দিতে হবে) ওহ! তাই নাকি? থ্যাংকস।

তারা দুইজন এখন সিনেমা দেখছে ‘দি স্পিড’। মোনার পাশের লোকটা হা করে সিনেমা দেখছে। এই অসাধারন সিনেমার ঢিসুমাইক ঢিসুম ঢাসুম দেখে মোনার বমি বমি লাগছে। মোনা কি তাকে বলবে চলেন বের হয়ে যাই। নাহ এই লোকের পুরো সিনেমা না দেখে বের হলে পয়সা উশুল হবে নাহ। খাবারের বিল দিতে গিয়েও ২ বার বলেছে- দাম এত বেশি কেনও???

-হ্যালো রাফসান তুই কই।
-আমি বাসায়।
-বাসায় বসে বসে কি করিস ঘাস কাটিস নাকি।
-নাহ আমারতো আর কেউ নাই যার সাথে সিনেমা দেখবো....
-এই তুই জানলি কিভাবে!! তুই আমাকে ফলো করছিস নাতো।
-কি যাতা বলিস।

রাফসান সত্যিই ফলো করছিলো। তবে টিকিট কাটার টাকা ছিলোনা বলে সিনেমা হলে যেতে পারেনি। যেইদিন থেকে শুনেছে মোনার বিয়ে হয়ে যাবে, সেই দিন থেকেই তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আচ্ছা সে কি কখনোই মোনাকে বলতে পারবে নাহ তাকে কত যে ভালবাসে।

-কিরে লাইব্রেরিতেই বসে থাকবি, ক্লাসে যাবি নাহ।
-না তোরা যাহ আমার কিছু কাজ বাকি আছে।
-যাহ তুই বসে বসে বই গেল। হি হি হি।

মোনার হাতে একটা আংটি, মনে হয় হিরের। মোনা কি সত্যি সত্যি খুব খুশি। কিন্তু আমি যে তাকে ভালবাসি।
‘বন্ধু তুমি চলে যেওনা,
আমার কষ্টের পাতা মাড়িওনা।
জানো না কত গোপনে ভালবাসি তোমায়,
তবে একটু সময় করে পড়ে নিও,
লেখা বই গুলো আমার অজানায়।’(-নাঈম)

-হ্যালো রাফসান জানিস বেটাকে যতটা আনরোমান্টিক ভেবে ছিলাম ততটা নাহ।
-কেন কি হইছে।
-কাল বাসার গেটে এক তোরা ফুল আর একটা নীল খাম রেখে গেছে। হি হি হি। জানিস কি লেখেছে নাহ তোকে বলবোনা। টপ সিক্রেট।

হা হা হা। ফুল গুলা রাফসানই রেখে এসেছে। আর কি লেখা সে জানে।
প্রিয় মোনা,
তোমায় নিয়ে কবিতা লিখেছি, কেন লিখছি জানি না।

‘এই মেয়ে তোমার বুকের মাপে একখানি জমি চাই,
তোমার সন্ধানে আছে কি!!
আজ যদি বলি ভালবাসি তুমি মানবে কি?
নীল বেদনায় উর্বররতায় ভাটা পড়বেনা জেনো,
দয়া করে এক্টিবার আমার বাড়ি হয়ে যেও
পাই পাই হিসেব চুকে জমি বুঝে দিও।’(-নাঈম)

পছন্দ না হলে কিছুই করার নাই, অনেক ভালবাসা তোমার জন্যে।
ইতি
ছায়া সঙ্গি।

-হ্যালো মোনা কি করেন।
-এই যে আপনি এত ঢং করেন কেন বলেনতো!! কিছু দিতে হলেতো হাতে দিতে হয় তাই না। এদিক সেদিক রাখলে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে তাই না।
-না মানে আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝলাম নাহ। আমিতো আজই ঢাকায় আসলাম। গত ৪ দিন ধরেতো আমি গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম।

মোনার কিছুই মিলছে না। সে যদি না দিয়ে থাকে তবে কে দিলো, কে??

আজ মোনার গায়ে হলুদ। সবাই খুব আনন্দ করছে। কিন্তু মোনার মন সেই ফুল আর চিঠির কথা মনে করে খুত খুত করছে। ছায়া সঙ্গী টাই কে??

-এই পাপড়ি, রাফসান কইরে। ও আসে নি। তোরা ওকে কিছু বলিস নি। আমি ফোনে কত ট্রাই করলাম।
-না ও আসেনি। মোনা দোস্ত একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
-কর।
-তুই কি এই বিয়েতে খুশি।
-হঠাত এই কথা কেন বলছিস। আমার খুশি অখুশিতে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু তুই কেন এই কথা বললি।
- ইয়ে মানে রাফসান তোকে খুব ভালবাসে রে। তুই ওকে ভুল বুঝিস না। আমাকে ও কিছুই বলে নি। ওর একটা নোট খাতায় দেখলাম তোকে নিয়ে লেখা। আর গত পরশু দেখি রাস্তায় পাগলের মত বিড় বিড় করতে করতে হেটে যাচ্ছে। আমি অনেক ডাকলাম কিন্তু শুনে নি।

মোনাও কিছুটা বুঝতে পেরেছিল অনেক আগেই। কিন্তু সেও ওয়েট করছিল রাফসান কিছু বলে কিনা।

মোনার সব কিছুই এলোমেলো লাগছে। কিছুই ভাল লাগছে নাহ। আজ মোনার বিয়ে। কিন্তু সে মোটেও খুশি হতে পারছে না। কি যেন অজানা কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতর।

-কিরে তোরা পার্লারে যাস নাই এখনো।
-যাই মা।

পার্লারে যাওয়ার পথে কোথা থেকে যেন একটা গাড়ি এসে মোনার রিকসাটা দুমড়ে মুচরে দিল, সাথে মোনাকেও।

প্রায় ৩ মাস পর মোনা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলো। মোনার আশে পাশে অনেক কিছু বদলেছে। সবচেয়ে বদলেছে মানুষের চোখের চাহনি। সবাই তার হুইল চেয়ারের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার বলেছে পায়ের হাড় গুড়ো হয়ে গেছে আর মোনা কখনই মা হতে পারবে নাহ।

সেই টাক মাথা ভেড়া বিয়ে ঠিকই করেছে, তবে অন্য কাউকে যে সুস্থ এবং প্রতি বছর ক্যাপসুল নিতে কোন আপত্তি করেনি।

-বাবা তুমি বিয়েটা ভেঙ্গে দিও না। আমি হাত জোড় করছি।
-না না আংকেল এইটা কি বলেন, আমি এত পয়সা খরচ করে একটা রোগি বিয়ে করবো নাকি।

মোনার দিন কাটছে কখনো শুয়ে, আবার কখনো বারান্দায় বসে থেকে।

মনকে একটাই সান্তনা দিচ্ছে ঐ ভেড়াটার সাথে বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে। বিয়ের পরে যদি এই এক্সিডেন্ট টা ঘটতো তবে তো ভেড়াটা তালাক দিয়ে চলে যেত। নাহ মোনার কষ্ট হচ্ছে, দেখি তার কষ্ট দূর করে দেই। আমি লেখক আমি সব কিছুই করতে পারি।

-স্লামালায়কুম আংকেল।
-ওয়ালাইকুমসালাম। কে তুমি?
-আমি রাফসান, মোনার সাথে পড়ি।
-আসো ভেতরে আসো।

রাফসানের খুবি কষ্ট হচ্ছে। খুবি কান্না পাচ্ছে। মোনা চেয়ারের হুইল ঘুরিয়ে একটু একটু করে সামনে আসছে।

-কিরে রাফসান এত দিন পর কেমন আছিস।
-ভালো তুমি কেমন আছো।

মোনা অবাক হয়েছে রাফসান তাকে তুমি করে বলছে। কিন্তু আরো বেশি অবাক হচ্ছে, রাফসান ফুপিয়ে কাঁদছে। মোনা কি তাকে তুমি করে বলবে!! নাহ তার খুব লজ্জা লাগছে।

-এই বোকা তু তুমি কাদছো কেন?
-আমার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে। মোনা আমাকে বিয়ে করবে, প্লিজ।

মোনা কি বলবে সে সত্যিই জানে নাহ।

-আমি তোমাকে ধোকা দিতে পারবো না। আমার মা হবার.....
-প্লিজ আমি সব জানি। হাসপাতালে তুমি যতদিন ছিলে আমি প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়েছি।
-কিন্তু আমি মানুষ থেকে এখন একটা বস্তু মাত্র...কেন নিজেকে আমার সাথে জড়াতে চাও কেন??
-শোন আমি তো বেশি কিছু চাইনি...শুধু তোমার বুকের মাপের একখন্ড জমি....

মোনা কাঁদছে। তাহলে রাফসানই তার ছায়া সঙ্গি। এত ভাল কেন বাসে তাকে। সে কি তার ভালবাসার যোগ্য!!!

মোনার বাবা মায়ের দেয়া ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। আজ মোনা আর রাফসানের বাসর। রুমের লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জানলার ফাক গলে চাদের আলোয় পুরা ঘর আলোকিত। রাফসান মোনার বুকে শুয়ে আছে।
-মোনা
-হুম
-একটা কবিতা শুনবে।
-হুম

‘হুম হুম করেই কি বাসর কাটবে
নাকি কিছু এলেবেলে দুষ্টোমি চলবে।
দীর্ঘ রাত হোক আরো দীর্ঘ
তুমি আমি, আমি তুমি দুরন্ত ছুটে চলা
হোক নিরব রাজ্যের সকল গলিতে।’ (-নাঈম)

.....................................................................

কিছু কথা না বললেই নয়-
বাবা মা আমাদের সব সময়েই ভাল চায়। এইটা চিরন্তন সত্য। তারা ভালবাসার মিছিলে ১৪৪ ধারা জারি করবেই এইটাও সত্য।
কিন্তু মোনা যদি সুস্থ হত তবে কি তার বাবা কোন ভাবে রাফসানের সাথে বিয়ে দিত। never ever। মরে গেলেও না।
যদি বাবা মার ছেলে বা মেয়েকে একটা সুন্দর মোড়কে পেচানো কোন বস্তু ধরি, তবে বাবা মা কি আমাদের ভালো ক্রেতার কাছে বিক্রি করার জন্যে সপ্ন বুনছে নাহ!! সেই ক্রেতার এই বস্তুটাকে যদি পছন্দ না হয় তবে সে হয়তো তা ফিরিয়ে দিবে নতুবা ফেলে দিবে। ক্রেতার এমন আচরন কি শুধুই বস্তুটির দুর্ভাগ্য। বাবা মাকে ছেলে মেয়ের জীবন নিয়ে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে। আল্লাহর রহমতে পবিত্র ভালবাসা সপ্ন আর ঘর দুইটাই বাধতে জানে। (নাঈম-নয়ন)

1 টি মন্তব্য:

  1. ভাল লাগল। আরেকটা কথা, আমার নামও কিন্তু রাফসান, তাই বো্ধহয় গল্পটা আরও ভাল লেগেছে।

    উত্তরমুছুন