রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১২

গরীবের প্রেম (ফরমালিন মুক্ত)

Md. Sakawat Hossain Munna


অফিস থেকে আসার পথে একটা পেপার স্ট্যান্ড পড়ে। প্রায়ই পেপার,
ম্যাগাজিন কেনা হয় ঐ স্ট্যান্ড থেকে। যে ছেলেটা থেকে কিনি তার
সাথে খাতির হতে বেশিদিন লাগেনি। ছেলেটার নাম সাদেক। নতুন
ম্যাগাজিন আসলে আমাকে সে ফোন করে জানায়।
সেদিন স্ট্যান্ডে ভিড়-টিড় কম। সাদেকের সাথে গল্প জমিয়ে দিলাম।
আমার আবার অভ্যাস খারাপ। কথাটা একটু বেশিই বলি।
“সাদেক তুমি এখানে কয়টা পর পযন্ত পেপার বিক্রি করো?”
“ভাই আমি এখানে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকি। তারপর
আবার দুপুর ৩টা থেকে একটা গার্মেন্টসে কাজ করি। রাত
১২টা পর্যন্ত।”


শুনে অবাক হলাম আমি। “বাপরে! এত খাটো কি জন্যে?”
“ভাই আমার বাবা নাই। মা আর ছোট ভাই দেশের বাড়ি থাকে। তাদের
টাকা পাঠাতে হয়। ছোট ভাইটার পড়ালেখার খুব শখ। তাই সেটারে কাজ
করতে দিই না।” একরাশ ক্লান্তি নিয়ে জবাব দিল সাদেক।
“খুব ভালো। কিন্তু দুর্বল লাগে না এত কাজ করে?”
“না ভাই। আগে খালি গার্মেন্টসে কাজ করতাম। এখন এই পেপার
বিক্রির কাজটা নিছি ভিন্ন কারণে।”
“ভিন্ন কী কারণ?” প্রশ্ন শুনে সাদেক মিয়া দেখি মাথা নিচু
করে লাজুক হাসি দিচ্ছে।
“আরে কি ব্যাপার? লজ্জা পাচ্ছো নাকি? ঝেড়ে কাশো। কাহিনী কি?”
তাড়া লাগালাম আমি।
“ভাই এই কাজটা নিছি শেফালির জন্যে।”
ওরে বাপরে এ দেখি নারীঘটিত ব্যাপার। “শেফালি কে?”
জিজ্ঞাসা করলাম।
“আমি যে মেসে থাকি, তার পাশেই থাকে। তার
মা তারে গার্মেন্টসে পাঠাইবার চায়। কিন্তু আমি বলছি ওর পড়ালেখার
খরচ আমি দিবো। এখন আমি গার্মেন্টসের
টাকা থেকে শেফালিরে দিলে আমার মা আর ভাইয়ের কম পড়বে। তাই এই
কাজ নিছি।”
সাবাস বাঘের বাচ্চা! মনে মনে বাহবা দিলাম আমি।
“তো তোমার শেফালি, পড়ালেখা ঠিকমত করে তো?”
“জি ভাইজান। পড়ালেখার খুব শখ। আর একটু বসেন। এখনই আসবে।”
“এখন আসবে কেন?” অবাক হলাম আমি।
“আমার দুপুরের খাবার নিয়া আসবে। এত বলি না আনতে, শুনে না।
হোটেলের খাওয়া খাইলি নাকি আমার অসুখ করবে।” সব দাঁত
দেখিয়ে হাসি দিল সাদেক।
“বাহ! ভালো। খাবার খাও কোথায়?”
“ওরে নিয়া আমার রুমে বসি খাই। আমরা তো আর
ট্রেডিং করতে পারি না। ওটাই আমাগো ট্রেডিং।”
“আরে গর্দভ! ওটা ট্রেডিং না। ডেটিং।” হেসে শুধরে দিলাম আমি।

“জি জি, ডেটিং। আমারে শেফালি প্রায়ই শিখায়। মনে রাখবার পারি না।
আমারে বলছে, বিয়ের পর সে পড়াবে। নইলে নাকি ছেলে মেয়ে ভুল
শিখবে।” মাথা নিচু করে হাসতে হাসতে বলল সাদেক।
“তো সাদেক মিয়া ছেলে মেয়ে কয়টা নিবা?” উসকে দিলাম আমি।
“আর বইলেন না। সেটা নিয়াও শান্তি নাই। ওদের কলেজের
আপা নাকি বলছে, দুইটার বেশি না নিতে।”
“ঠিকই তো বলছে। কেন তোমার কি ইচ্ছা?”
“আরে ভাইজান, হিসাব নিকাশ করি কি ছেলে মেয়ে হয় নাকি?” সাদেকের
উদাস মুখে জবাব।
সর্বনাশ!! ব্যাটা দেখি বাচ্চা কাচ্চা দিয়ে বাংলাদেশ
তামা তামা করে ফেলবে। “কয়টা নিতে চাও তুমি?”
“এই ধরেন ছয় সাতটা। ঘর ভর্তি হইচই না থাকলে আর কি মজা?”
“ছয় সাতটা!” আঁতকে উঠলাম আমি। “আই পি এলে টীম
পাঠাবা নাকি?”
কথা বলতে বলতে শেফালি বেগম হাজির। শ্যামলা রঙের
মায়াকাড়া চেহারার একটা মেয়ে। আমার সাথে পরিচয় হলো।
মেয়ে দেখি খুব স্মার্ট। সালাম দিয়েই বলল, “ভাইয়া আপনার কথা ওর
মুখে শুনছি। আপনি একটা বিচার করেন।”
আমি মুখে গাম্ভীর্য এনে বললাম, “বলে ফেলো, কী বিচার?”
“ও প্রতিদিন এত কষ্ট করে। রাতে গার্মেন্টস থেকে এসে ঘুমায় না।
আমার সাথে মোবাইলে কথা বলে। আমি এত মানা করি শুনে না। প্রায়
২ঘন্টা কথা বলে।”
“সাদেক এইসব কী?”

“ভাই ফোনে ওর আওয়াজ অন্যরকম লাগে। আর সারাদিন এত খাটুনির
পর, ওর কথা না শুনলে ঘুম আসে না।”
ওরে আমার রসিক নাবিক। মনে মনে হাসলেও ভাব নিয়ে বললাম,
“চলবে না এইসব। এখন থেকে ডেইলি শুধু ৩০ মিনিট কথা।”
“খুব ভালো হয়ছে।” খুশি শেফালি।
“ভাই এটা আপনার কেমন বিচার।?” চেঁচিয়ে উঠল সাদেক। “আপনার
পায়ে পড়ি। সময়টা আরেকটু বাড়ান।”
“আচ্ছা যাও একঘণ্টা। শেফালি এক ঘণ্টা পর তুমি মোবাইল বন্ধ
করে দিবা।”

পরিশিষ্টঃ
রায় দিয়ে, বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠলাম। হঠাৎ দেখি খুব বৃষ্টি নামলো।
ভাবলাম শেফালি আর সাদেকের ‘ট্রেডিং’ আজ ভালই জমবে।
একটা ব্যাপার ভেবে অবাক লাগলো। আমার ফ্রেন্ডরা তাদের
গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কেএফসি, পিজাহাটের মত নামী-দামি জায়গায়
ডেটিং করে। কথায় কথায় দামি-দামি গিফট। তারপরেও কত সন্দেহ, কত
সমস্যা। আর সাদেকরা কত গরীব। তারপরেও কত খাঁটি, কি চমৎকার
প্রেম! শেফালি,সাদেক তোমরা ভালো থেকো।
মনে মনে প্রার্থনা করলাম আমি। আমার প্রার্থনার জোরেই যেন
জোরেশোরে নামল বৃষ্টি।


মুল গল্প

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন