শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১২

“রঙ”


By- Fabiha Nisa

অনন্যা আয়নার দিকে মুখ করে তার লম্বা চুলে চিরুনি দিচ্ছিল। এমন সময় তার মা এসে বলে, “দে চিরুনি দে আমাকে, আমি বেণী করে দেই”। “না মা, আমি পারব এবং তোমার চেয়ে আরও ভাল বেণী করে দেখাবো”। যদিও অনন্যা চোখ দিয়ে পৃথিবীর কোন আলো দেখতে পায় না, তবুও আয়নার দিকে মুখ করে চুল আঁচড়াতে তার মন্দ লাগে না, বরং বেশ ভালোই লাগে।

ষোল বছর বয়সী অনন্যা অন্ধ হলেও সবধরনের কাজ সে খুব সহজেই করে ফেলতে পারত। এলাকায় এমন কথাও শোনা যেত যে অনন্যার আধ্যাত্মিক জ্ঞান আছে। গল্প বলার এ পর্যায়ে এসে দীপ্তি তার ছোট বোনকে বলে, “গল্পের বাকি অংশ পরে শুনিশ। এখন ঘুমাতে যা, রাত হয়েছে”। “না আপু, তুই এখনি বল, গল্প শেষ না করলে ঘুম আসবে না”, দিয়া জেদ করে। দুই বোন পিঠাপিঠি হওয়ায় সারাদিন এক সাথে লেগে থাকে। কিন্তু দীপ্তি বুঝিয়ে বলে যে এক্ষণই মা এসে তাদের বকা দিয়ে যাবে। দিয়া নিজের রুমের উদ্দেশ্যে যাওয়ার আগে তার বড় বোনকে জিজ্ঞেস করে, “আপু, এটা কি তুই তোর নিজের জীবন কাহিনী বলছিস?” “ধুর! আমারটা কেন হতে যাবে? তুই কি মনে করিস পৃথিবীতে তোর বড় বোন ছাড়া আর কোন অন্ধ নেই”? দিয়া হেসে রুম থেকে চলে যায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দিয়া তার বোনের রুমে যায়। গিয়ে দেখে মা দীপ্তির চুলে বেণী করে দিচ্ছে। দিয়া আহ্লাদের স্বরে বলে, “কি মা! তুমি খালি আপুকেই আদর করো”। “বেশি প্যাঁচাল পারিস না, সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠার পর আবার বড় বড় কথা! যা পড়তে বয়”। এই বলে মা রুম থেকে চলে যায়। দিয়া অস্থির হয়ে তার আপুকে গল্প শুরু করতে বলে। দীপ্তি মুচকি হেসে গল্প শুরু করে।


অনন্যা খুব মেধাবী একটা মেয়ে ছিল। বাবা-মার একমাত্র সন্তান হওয়ায় ভালবাসা আর আদরের কোন কমতি ছিল না অনন্যার। একদিন হঠাৎ কেন যেন অনন্যার মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে যায়। তখন রাত হয়েছে। অনন্যা তার মায়ের সাথে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ মা কে প্রশ্ন করে, “ মা, রঙ কি জিনিস?” মা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। অনন্যা আবার প্রশ্ন করে, “ মা, আমি দেখতে কেমন? আমার গায়ের রঙ কি?” মায়ের উত্তর না পেয়ে অস্থির হয়ে আবারো বলে, “ মা বলনা! রঙ কি জিনিস?” “আমি যে শাড়িটা পড়ে আছি তার রঙ লাল”- মা গলার স্বর একদম নামিয়ে উত্তর দেয়। অনন্যা আবার বলে, “মা, লাল রঙ কি? আমার কাছে তো সব রঙই এক, কালো, অনেক অন্ধকার”। মা নিঃশব্দে মেয়ের কথা হজম করতে থাকে। অনন্যা বলে উঠে, “মা, তুমি যে কাঁদছ তোমার চোখের পানির রঙ কি?” মা তার মেয়েকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটি বুঝতে পারে তার প্রশ্নের উত্তর মায়ের কাছে নেই।

তার পরের কয়েকদিন অনন্যা অনেক মনমরা ভাবে থাকে। সারাদিন বাসার পাশের পুকুরপাড়ে বসে কাটায়। তার মা মেয়েকে বিভিন্ন ভাবে আনন্দ দেবার চেষ্টা করে কিন্তু মা বুঝতে পারে যে অন্ধত্ব মেয়ের মধ্যে গভীর অন্ধকার ঢেলে দিয়েছে। একদিন মধ্যরাতে হঠাৎ মায়ের ঘুম ভাঙ্গে। মা দেখে পাশে অনন্যা নেই। সে জানালার ধারে বসে আছে। মা গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। অনন্যা বলে, “মা, মৃত্যুর পর আমি কি আলো দেখতে পারব?” মা অপ্রস্তুতভাবে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ তো মা আমার! অবশ্যই দেখতে পারবি। তুই তো কোন পাপ কাজ করিস নি। জান্নাত হবে তোর স্থান। সেখানে এতো আলো যে তোর চোখ ঝলসায়ে যাবে”। এতক্ষণে মেয়ের মুখে হাসি ফোটে। মা কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। সে রাতে মা আর মেয়ে অনেক গল্প করে।

পরের দিন সারা বেলা জুড়ে অনন্যার কলরবে বাড়ির চারপাশ মুখরিত হয়ে থাকে। রাতেবেলা মেয়েকে একদম বুকের কাছে নিয়ে মা ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ মধ্যরাতে মা ঘুম ভেঙ্গে দেখে মেয়ে পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে সকাল হয়ে যায়। মেয়েকে কোথাও পাওয়া যায় না। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পরবর্তীতে পুলিশ বাড়ির পাশের পুকুর থেকে মেয়ের লাশ উদ্ধার করে।

গল্প বলা শেষ করে দীপ্তি ছোট বোনকে একটা চিমটি কাটে। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে তখন দিয়া। কিন্তু তা আপুকে বুঝতে দেয় না। কেবল প্রশ্ন করে, “আপু, তুই এই গল্পটা বলে কি বোঝাতে চাচ্ছিস? আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাস তুই?” দীপ্তি হেসে উঠে বলে, “নারে পাগল! গল্পের সাথে কি আর সব ক্ষেত্রে বাস্তব জীবনের মিল হয় নাকি? চোখের আলোই কি সব? মনের আলো বলেও কিছু জিনিস আছে। আর সেই মনের আলো দিয়েই তোদের ভালবাসা আমি উপলব্ধি করি”। দিয়া কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। দীপ্তি আবার বলে, “জীবন থেকে মুক্তি নেওয়া কোন সমাধান না। এটা কেবলই হার স্বীকার করা। আর তুই জানিস যে তোর বোন কখনো হার স্বীকার করে না। তোর সাথে মারামারির ক্ষেত্রেও না”। দুইজনের মুখেই হাসি ফোটে। কিন্তু পরক্ষনেই দিয়া আবার কান্নার স্বরে বলে, “তাহলে তুই এই পঁচা গল্পটা আমাকে কেন বললি?” দীপ্তি তখন গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয়, “পৃথিবীতে প্রতিদিন যে মানুষগুলো আত্মহত্যা করছে, তারা এটা ভাবছে না যে তাদের পর তাদের প্রিয় মানুষগুলোর কি হবে। তারা এটাও ভাবছে না যে তারা যে কষ্টের কারনে আত্মহত্যা করছে সেটিও সাময়িক। তারা কেবল মোহে পড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। তারা একটু সচেতন হলেই প্রতিদিন এতোগুলো মানুষের চোখের পানি ফেলানোর প্রয়োজন হয়না”।

মা রুমে এসে দেখে তার দুই মেয়ে হাসছে, প্রান খুলে হাসছে। তার চোখে পানি এসে যায়। মনে মনে বলে, “এজন্যই মনে হয় এদের নাম দিয়া আর দীপ্তি রেখেছিলাম। ঘরটাতে আমার কতো আলো!”

--সংগ্রীহিত্তত--

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন