আকাশ দিকে ঘাড় উঁচু করে উদাস মনে হাঁটছিল অমি(ছদ্মনাম)। ধাক্কা খাওয়ার সাথে সাথেই থমকে দাঁড়ালো সে এবং মানুষটা। আনুমানিক ৬০-৬৫ বছরের বেশি হবে বয়স। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন অমির দিকে। অমি সাথে সাথে বলল, ‘সরি, ব্যাথা পাননি তো? কেমন আছেন আপনি?’
কিছু বললেন না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টির মাঝে শুন্যতাটা আর বেশি লক্ষ করলো সে। অমি আবার বলল, ‘আপনি ভালো আছেন?’ এবারও উত্তর মিলল না। চামড়ার নীচে কিলবিল করা হালকা নীলচে রক্তনালীসমৃদ্ধ একটা হাত তিনি অমির বাম কাঁধে রাখলেন। অমি টের পেল হাতটা একটু একটু কাঁপছে। একটু পর কাঁপা কাঁপা গলায় বুড়ো লোকটি বললেন, ‘কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে তোমার?’
‘আছে, তবে মাঝে মাঝে।‘
‘ও! তোমাকে তুমি করে বলা যাবে তো?’
‘অবশ্যই!’
মানুষটা অভিবাবকসুলভ অমির হাতটা ধরে এগিয়ে যেতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ও দুঃখিত, তোমার সময় আছে তো?’
ধন্যবাদ। মানুষটা অমির হাত ধরে এগুতে লাগলেন। একটা বার থেকে কফি পান শেষে কলসসেও এর পাশে পার্কের দিকে এগুলো তারা। সবুজ ঘাসের উপর বসতে বসতে বললেন, ‘আজ একটা কথা বলব তোমাকে। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তবু বলব। তুমি যেভাবে আন্তরিকতা নিয়ে বললে- আপনি ভালো আছেন, গত ১১ বছরে কেউ আমাকে এভাবে মুগ্ধকর আন্তরিকতায় কোনোরকম কুশল জিজ্ঞেস করেনি। তোমার বিশ্বাস হয়?’
কিছু বলল না অমি। তিনি একটু আয়েশি ভাবে বসে বললেন, ‘সকাল হলেই আমার মনে হয় আর একটা যন্ত্রণাময় দিন কাটাতে হবে আমাকে। ভোরেই ছেলে অফিসে যায়, ছেলের বউটাও। দুজনই চাকরী করে। বাড়িতে তখন আমি ওদের ৫ বছরের ছেলেটা আর কাজের মহিলাটা থাকে। এই সময় টুকু আমার ভালোই যায়। ঠিক বিকেল হলেই আমি অস্থির হয়ে যাই। তখন আমার ছেলে আর তার বউ বাসায় ফেরে। জানো, অরা সারাদিন আমার সঙ্গে একটা কথাও বলে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। অথচ আমি আমার জীবনের সব আয় দিয়ে ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়েছি।‘
‘আপনার স্ত্রী-।‘
অমি কথাটা শেষ করার আগেই তিনি বললেন, ‘উনি তো মরে গিয়ে বেঁচেছে। জানো প্রতিদিন বিকেল হলেই তাই বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। হাঁটতে থাকি একা একা, চুপ করে শুধু ভাবতে থাকি। সবচেয়ে বেশি ভাবি কি জানো?’
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অমি মানুষটার দিকে তাকায়। চোখ দুটো ছল ছল করে তিনি বলেন, ‘যদি কখনও পরজনমে জন্মাই, তবে যেন পশু হয়ে জন্মাই। বৃদ্ধ বয়সে কোনো ছেলে-মেয়ের করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হবে না তখন!’
মানুষটা ঝট করে আকাশের দিকে তাকালেন। তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজতে থাকেন। ঝাপসা হয়ে আশা চোখে বিশাল আকাশের মাঝে তিনি খুঁজতেই থাকেন। মনুষ্যত্বের এই চরম পরাজয়ে দেখে মাথাটা নিচু করে ফেলে অমি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন